এসির বিদ্যুৎ বিল কমানোর উপায় - এসি চালিয়েও বিদ্যুৎ বিল করুন সাশ্রয়ী

এই তীব্র তাপমাত্রার কারণে সৃষ্ট অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় এসি এই সময় বিলাসিতার নয় বরং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। আর এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী। তবে এর পাশাপাশি এটি ব্যবহারের ফলে আসা বিদ্যুৎ বিল নিয়ে আমরা অনেকেই চিন্তিত এবং সংশয়ে থাকি।


আজকের এই প্রবন্ধের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের কৌশল গুলোর উপরে আলোকপাত করা হবে। যেখানে পাঠকরা এসির বিদ্যুৎ বিল কমানোর উপায় জানার পাশাপাশি এই সম্বন্ধিত আরো কিছু তথ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন।

এসির বিদ্যুৎ বিল কমানোর উপায়

একটি সময় বাসা বাড়িতে শুধুমাত্র ফ্যানের ব্যবহার করে গ্রীষ্মকাল কাটিয়ে দেওয়া সম্ভবত কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর প্রভাবে যেই হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এর সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাসা বাড়িতে এসির ব্যবহার। কিন্তু অনেকেই এক্ষেত্রে হুরহুর করে বেড়ে যাওয়া বিদ্যুৎ বিল নিয়ে চিন্তিত। স্বাভাবিকভাবেই এসি ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ বিল কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায় কিন্তু আপনি চাইলে কিছু কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এসির বিদ্যুৎ বিলের খরচ কমিয়ে আনতে পারেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক কৌশল গুলো সম্পর্কে।
  • সঠিক তাপমাত্রা সেট করাঃ দিনের তুলনায় রাতে এসির ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। যেহেতু রাতে লম্বা সময় ধরে এসি চলে সেক্ষেত্রে এসির তাপমাত্রা যত বেশি তে সেট করবেন তত কম বিদ্যুৎ খরচ হবে। এসির তাপমাত্রা যত কম রাখা যায় কম্প্রেসার তত বেশি চলে এবং এর কারণেই মূলত বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। অনুমান করা যেতে পারে প্রত্যেক ডিগ্রির তাপমাত্রা কমানোর জন্য ৬ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। চাইলে প্রথমে কিছু সময় কম তাপমাত্রায় এসি সেট করে ঘরের ভেতর একটি আবহ ও তৈরি করার পর ঘুমানোর পূর্বে তা একটু বেশি তাপমাত্রায় সেট করলে সারা রাতে তুলনামূলক বিদ্যুৎ খরচ কম হবে।
  • ঘুমানোর পূর্বে এসির টাইমার সেট করুনঃ আমরা অনেক সময় ঘুমানোর পূর্বে এসি অন করে তা সারা রাতের জন্যই চালিয়ে রেখে দিই যদিও এসি ব্যবহারে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঘর ঠান্ডা করতে বড়জোর দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগে এবং পরে গভীর ঘুমে নির্দিষ্ট সময় পর তা আর বন্ধ করা হয় না। এইজন্যই এসির ফিচারস এর ভিতরে টাইমার অনেক বেশিই কার্যকরী। এসিতে সেট করে রাখলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরই তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা যদি একটি নির্দিষ্ট সময় অনুমান করে টাইমার সেট করি এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ এবং বিদ্যুৎ বিল দুটোই সাশ্রয় হবে।
  • প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাট এর ব্যবহারঃ প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাট ব্যবহারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এসির তাপমাত্রা কম বেশি করা যায়। ধরন স্বরূপ বলা যায় দিনের বেলা যখন সূর্যের তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং গরম বেশি থাকে সেই সময় তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রিতে রাখতে পারবেন এবং রাত বারোটার পর কিংবা মধ্যরাতে এটি নিজে থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চলমান থাকবে এবং সকাল সাতটায় আপনি চাইলে আবার ২০ ডিগ্রিতে নিয়ে আসতে পারবেন। এটি বিদ্যুৎ বিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনতে অত্যন্ত উপযোগী একটি ডিভাইস। আপনাকে এটি ব্যবহারের ফলে বারবার তাপমাত্রা ম্যানুয়ালি নির্ধারণ করতে হবে না। আরেকটি বিশেষ খেয়াল রাখার বিষয় হল ২৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর উপর তাপমাত্রা রাখলে আপনি বিদ্যুৎ খরচ আরো বেশি বাঁচাতে পারবেন।
  • এসির ফিল্টার পরিস্কার রাখাঃ ব্যবহৃত এসির ফিল্টার যদি এ ময়লা জমে থাকে সে ক্ষেত্রে রুম ঠান্ডা করতে এসির কম্প্রেসার কে তুলনামূলক অতিরিক্ত শক্তি খরচ করতে হয় এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ বিলের উপর তাই প্রতি মাসে অন্তত একবার এসির ফিল্টারটি বের করে ওয়াস ক্লোথ দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করুন।
  • এসির ভেন্ট সিলিং এর দিকে তাক করুনঃ এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে ঠান্ডা বাতাস উপর থেকে নিচ দিকে আপনার কাছে ভেসে আসবে। সুতরাং ভেন্টগুলো নিবদ্ধ না রেখে উপর থেকে নিচের দিকে রুমটি ঠান্ডা করা উচিত।
  • ঘরে মোটা পর্দার ব্যবহারঃ আপনার বসবাসকৃত ঘরে তাপমাত্রা যত বেশি হবে এসিকে ঠিক তত বেশি শক্তি ব্যয় করতে হবে তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য এবং এর ফলে এসি দীর্ঘ সময় ধরে চালাতে হয় এবং বিলো বাড়তে থাকে চড়চড় করে। আপনি যদি ঘরে মোটা পর্দার ব্যবহার করেন তাহলে বাইরের গরম হওয়া ও আলো কম আসবে এবং তুলনামূলক ঘরে তাপমাত্রা কম থাকবে সুতরাং ঘরে মোটা পর্দা ব্যবহার করায় শ্রেয় হবে।
  • 24° সেলসিয়াস এ এসির ব্যবহারঃ সাধারণত গ্রীষ্মকালীন সময়ে দৈনিক দিনের বেলা বাইরের তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠানামা করতে থাকে এক্ষেত্রে আপনি যদি দিনের বেলায় এসি ব্যবহার করেন তাহলে তা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়া স তাপমাত্রায় সেট করায় শ্রেয়। আরো জেনে রাখা ভালো এই সময় শরীরের তাপমাত্রাও ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকে সুতরাং নিজের অভ্যাসে একটু পরিবর্তন আনার ফলে বিদ্যুৎ বিল অনেকটাই সাশ্রয় করা যায়। রাতে যেহেতু আবহাওয়ায় তাপমাত্রা আরো কম থাকে সেক্ষেত্রে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ আপনার এসির তাপমাত্রা সেট করে আরামের ঘুম দেওয়া অবশ্যই সম্ভব।
  • এসির সঙ্গে ফ্যানের ব্যবহারঃ এসির সঙ্গে সিলিং ফ্যানের ব্যবহার এ বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। অনেকে মনে করেন দুটো জিনিস একসাথে চালালে হয়তো বিদ্যুৎ বিল আরো বেশি পরিমাণে আসবে কিন্তু বিষয়টি আসলে তা নয়। সিলিং ফ্যান ব্যবহারের ফলে সারা ঘরে এসির শীতল বাতাস তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে। আপনি যদি এসির সাথে সিলিং ফ্যানের ব্যবহার করেন তাহলে দেখতে পাবেন এসির তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত আপনি বাড়িয়ে রাখতে পারছেন। তবে এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে আপনার ব্যবহৃত সিলিং ফ্যানটি যেন ঘড়ির কাটার দিকে চলে। এতে করে সিলিং ফ্যান ঠান্ডা বাতাসকে নিচের দিকে ঠেলে দিবে।
  • সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় এসি ব্যবহার না করা ভারতের ব্যুরো অব এনার্জি এফিসিয়েন্সির এক তথ্য বার্তা মোতে মানুষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মূলত এটি তুলে ধরার কারণ হলো অনেকেই এই এসি সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় ব্যবহার করে থাকেন যা সম্পূর্ণ ভুল।
  • বেশি পুরনো এসি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুনঃ ইলেকট্রনিক যন্ত্রই যত বেশি পুরনো হতে থাকে ততো এটি ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ বিল বেশি আসতে থাকে আর সময় এর সাথে সাথে এর কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া তো স্বাভাবিক বিষয়। এসির ক্ষেত্রেও বিষয়টি ভিন্ন নয়। অতিরিক্ত পুরনো এসি ঘরকে ঠান্ডা করতে তুলনামূলক অনেক বেশি সময় নিবে যার ফলে এসির কম্প্রেসার এর প্রয়োগ বেশি হবে এবং বেশি শক্তি ব্যয় হবে যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ বিল বেশি আসবে। সুতরাং ব্যবহৃত এসির বয়স যদি অনেক বেশি হয়ে থাকে তাহলে তা পরিবর্তন করে ফেলাই উচিত হবে।

১.৫ টন এসির মাসিক বিদ্যুৎ খরচ

কোম্পানি ভেদে একটি ১.৫ টন নন ইনভার্টার এসি ১৪৫০ ওয়াট থেকে শুরু করে ১৮০০ থেকে ১৯৫০ ওয়াট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এইখানে আমরা একটি ১.৫ টন এসির পাওয়ার ১৮০০ ওয়াট ধরে মাসিক বিদ্যুৎ খরচ কত আসে তা বের করার চেষ্টা করব।

সাধারণত বিদ্যুৎ খরচকে এনার্জি খরচ বলা হয়ে থাকে। এনার্জিকে E দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
সুতরাং E এনার্জি নির্ণয়ের সূত্রটি হল E (Energy)= P (Power)×T(Time), এইখানে P দ্বারা power অর্থাৎ এসিটি মূলত কত ওয়াটের এবং Time দ্বারা এসডি কত সময় ধরে চলেছে তা বুঝায়।
সুতরাং এনার্জি নির্ণয় করতে হলে আপনাকে সময়ের সাথে পাওয়ারকে গুন করতে হবে।
Energy= Power × Time
= 1800 watt × 1 Hour
=1800 Wh (ওয়াট আওয়ার)
এইবার ওয়াট আওয়ার কে কিলোওয়াট আওয়ারে রূপান্তর করতে হবে আর এই কাজটি করার জন্য ওয়াট আওয়ার কে ১০০০ দিয়ে ভাগ করতে হবে।
= 1800wh ÷ 1000
= 1.8 KWH = 1 unit

এমত অবস্থায় এসে এক ইউনিট কত টাকা সে হিসেব করে টোটাল ইউনিটের সাথে গুণ করলেই এক ঘন্টায় কত টাকা বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে সে হিসাব পাওয়া যাবে।
ধরি,প্রতি ইউনিট = ৬ টাকা
এইখানে,
1.8 KWH × 6 Taka
= 10.08 Taka
অর্থাৎ আপনি যদি ১৮০০ ওয়াটের ১.৫ টনের নন ইনভার্টার এসি একটানা এক ঘন্টা চালান তাহলে আপনার বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ঘন্টার প্রতি ১০.৮ টাকা।
এভাবেই আপনি দৈনিক যত ঘন্টা এসি ব্যবহার করবেন তার সাথে এক ঘন্টায় যত টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে তা গুণ দিলেই কাঙ্খিত ফলাফল পেয়ে যাবেন।

এবার আলোকপাত করা যাক ১.৫ টন এসির মাসিক বিদ্যুৎ খরচ কত টাকা আসতে পারে।
ধরে নেওয়া যাক একজন মানুষ দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে এসি ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে ১৮০০ ওয়াটের একটি এসির দৈনিক বিল আসবে ১০.৮ × ১২ টাকা= ১২৯.৬ টাকা।
যেহেতু ৩০ দিনে এক মাস সেহেতু ১২৯.৬ টাকার সাথে ৩০ গুণ করলেই মাসিক এসির বিদ্যুৎ খরচ বের হয়ে আসবে।
= ১২৯.৬×৩০
= ৩,৮৮৮ টাকা।
সুতরাং ১.৫ টন এর ১৮০০ ওয়াটের একটি নন ইনভার্টার এসির মাসিক বিদ্যুৎ খরচ ৩,৮৮৮ টাকা।

১.৫ টন এসির দাম কত

বর্তমান সময়ে এসে তাপমাত্রার প্রকোপের ফলে এসি এখন বিলাসিতা নয় বরং প্রয়োজনীয়তায় রূপান্তর হয়েছে। আর এই এসি কেনার পূর্বে আমাদের সবারই মনে একটি প্রশ্ন থাকে এর দাম কেমন হতে পারে কিংবা দাম বেশি না কম। চলুন  করা যাক একটি ১.৫ টন এসির দাম সম্পর্কে।

বাংলাদেশ এ নতুন পুরাতন উভয় কন্ডিশনের এসি পাওয়া যায়। এর ব্র্যান্ড, টেকনোলজি, ফিচারস, কোয়ালিটি, টাইপ, এয়ার পিউরিফেকশন সিস্টেম ইত্যাদির উপর নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং বাজারে থাকা অন্যান্য এসির তুলনায় কমবেশি করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের বাজারে একটি ১.৫ টন এর এসির দাম সাধারণত ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে থাকে যা কিনা স্প্লিট টাইপ এবং পুরাতন কন্ডিশনের হয়ে থাকে। 

অপরপক্ষে একটি নতুন এসির দাম অর্থাৎ ১.৫ টন এসির দাম ৩৬,৯৯০ টাকাতো তো শুরু হয় এবং এই সকল এসি গুলোর ভিতরে বেশ কিছু ভালো এবং অত্যাধুনিক ফিচারস থাকে যেমন টার্বো কুলিং মোড, অটো ক্লিন, এডজাস্টেবল এয়ার ফ্লো ফিল্টার, ভয়েস কমান্ড, ডিজিটাল কন্ট্রোল ইত্যাদি। এ ব্যতীত ১.৫ টন ক্যাপাসিটির ইনভার্টার এসি আমাদের দেশে পাওয়া যায় যার দাম একটু বেশি।

আমাদের শেষ কথা

এসির সঠিক ব্যবহার আমাদের নাগরিক সচেতনতার অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু এসির তাপমাত্রা যত কম রাখা হবে বিদ্যুৎ খরচ ততটাই বেশি হবে সেহেতু অবশ্যই আমাদের এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে যেন অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ না হয় এক্ষেত্রে যেমন আমরা আমাদের বিদ্যুৎ বিল কমিয়ে আনতে পারব ঠিক তেমনি ভাবেই দেশের বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে পরোক্ষভাবে হলেও সাহায্য করতে পারব।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ইজি গ্রাব ওয়েব এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url